শনিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ০৩:০৪ অপরাহ্ন
রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা তখনো পড়িনি। দেখা হয়নি সে গল্প নিয়ে বানানো তপন সিংহের সিনেমার কাবুলিওয়ালার সাজে ছবি বিশ্বাসকে।
তবে খোকির জীবনটার পাঠ আমাকেও নিতে হয়েছিল। আরেক কাবুলিওয়ালার সাথে। জামালপুর শহরের ছেলেবেলাটায়।
তখন বোধহয় মফস্বল এলাকাগুলোতে কাবুলিওয়ালার বোধহয় বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়েই ছিল। নিজ বাসভূম ছেড়ে দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর তারা পরিবার পরিজন ছাড়া দিনপাত করত।
তারা ফেরির ব্যবসা করত। অন্দর মহলের মেয়েদের কাছে তাদের চাহিদা ছিল বেশ। ফেরিওয়ালাদের মতোই তারা পাড়ার রাস্তায় রাস্তায় হাঁকাহাঁকি করে ফিরতো তাদের পণ্যের কথা বলে। হাঁকাহাঁকিতে ঘরের রাস্তার ধারের কপাটগুলো পটাপট খুলে যেত।
কাবুলিওয়ালারা কি কি ফেরি করত, তার দিকে আমার কোনো আকর্ষণ ছিল না। আমার নজর ছিল তাদের ঢাউস কাপড়ের পোটলা থেকে বের করে আনা পেস্তা বাদাম আখরোট কিসমিসের দিকে। বিভিন্ন জাতের শুকনো ফল আর গরম মশলাও ছিল। তাদের কাছে মেয়েদের জন্য বিভিন্ন কাজকরা জামাকাপড় ইমিটেশনের গয়নাগাটি অলংকারও বোধহয় ছিল। তবে শুকনো ফলের ব্যবসাই তাদের সাধারণ ব্যবসা।
আব্বাদের জন্য তারা ভালো অর্থের যোগানদাতা। সুদের কারবারটাই তাদের জমজমাট। বিনা জামিনে ও জামানতে কোনো রকম দলিল দস্তাবেজের ধার না ধেরে শুধুই বিশ্বাসের উপর তারা লোকদেরকে চড়া সুদে টাকা ধার দিত। মাসে মাসে সুদ নিয়ে যেতো। আসল পরে দিলেও চলবে– যতো পরে পারো। তবে সুদটা নগদ নগদ। সেই থেকেই বোধহয় কথার চলতি হয়েছে: আসল নেহি সুদ মাংতা।
কাবুলিওয়ালাদের নিয়ে অনেক গল্প রঙ্গ তামাসা রয়েছে।
আমি তখনো স্কুলে যাই না। এক কাবুলিওয়ালা মাঝে মাঝেই আসতো আমাদের বাসায়। আমাকেই দেখতে। আমারই বয়েসি এক ছেলেকে সে রেখে এসেছে আফগানিস্তানের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আমাকে দেখতে পেলেই তার মন আনচান করে ওঠে। উথলে ওঠে হৃদয়।
আসার সময় কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসে আমার জন্য। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় গল্প করে আমার সাথে। আদরও করে। যাওয়ার সময় মুঠো ভরে কিসমিস দিয়ে যায়। কিসমিস আমার খুব পছন্দ। কিসমিস পেয়ে আমি চিংড়ি মাছের মতো লাফাতে থাকি।
কাবুলিওয়ালা চলে গেলে আম্মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। আমার ডানা ধরে ঝাকি দিয়ে বলেন, অতো ফাল পারিস না। কী মতলব কে জানে। ধরে নিয়ে ঐ পোটলায় তোকে পাচার করে দেয় কিনা কে জানে।
আমি বলি, তাই কি হয়? আমি তো তার ছেলের মতো।
আসলে সে সময় শহরে ছেলেধরা নেমেছে বলে জোর গুজব। ভয়টা সেখান থেকেই।
আম্মা গজগজ করতে থাকেন, ছেলে না ছাই। লম্বা ফরসা মানুষের ছেলে বুঝি তোর মতো কালো!
কিসমিসের কাছে কোনো শংকা কোনো যুক্তি কাজ করে না। কদিন পর সে আমাকে দেখতে আবার বাসায় এলে আমি আগের মতোই উচ্ছসিত হয়ে উঠি।
আম্মা আবার সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন, যতো মিষ্টি কথাই বলুক, ওরা অতো ভালো না। ওদের মধ্যে রহম নাই।
তা হলেও হতে পারে। শোনা যায়, কোনো লোক দেনার টাকা শোধ না করে মারা গেলে ওরা তার কবরে গিয়ে তার উপরই লাঠি পিটাতে পিটাতে পাওনা টাকা দাবী করতে থাকে। বেকায়দা বুঝে ওয়ারিশানরা এসে পাওনা টাকা শোধ করে।
বেশ কিছুদিন কাবুলিওয়ালা লোকটার দেখা নেই।
আমার খেয়াল নেই। আম্মাই একদিন বললেন, কাবুলিওয়ালাকে দেখেছিস?
আমারও খেয়াল হলো। বললাম, নাতো!
আম্মা অবাক হয়ে বললেন, কি হলো?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, বড়ো ভালো লোক ছিল।
লেখক: আতা সরকার, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখ
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.