বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ০৭:১৫ অপরাহ্ন
।। মো. শাহ্ জামাল ।।
সকালে সবার আগে সংবাদপত্র হাতে নেয়া একটি পুরোনো অভ্যাস। বর্তমান সময়ের সাথে তুলনা করলে এটাকে সভ্যতার নিদর্শনও বলা যায়। দেশ-বিদেশের তরতাজা খবরের নিত্য-নতুন শিরোনামের ভরপুর দেখা যায় সংবাদপত্রগুলোতে। এটি এক আজব মনে হবারই কথা। আমরা যারা সম্মানিত পাঠক আছি এটাকে কিভাবে ঝুঁকিমুক্ত সুন্দর উপস্থাপনায় এত দ্রুত প্রকাশ করা সম্ভব বলে মনে করতেই পারি। সচেতন পাঠকরা অনেকেই জানেন এই সংবাদপত্রের আদিঅন্ত। পাঠকের হাতে সকালেই সুন্দর উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ কত যে, কঠিন এবং কষ্টসাধ্য। তার বিবরণ নিয়েই আজকের প্রতিবেদন।
সারাদিনের জমানো খবরগুলো বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পত্রিকার অফিসে জমা হয়। একটা সংবাদের জন্য মাসের পর মাস বা তারাও বেশি সময় অনুসন্ধান চালাতে হয়। এরপিছে রয়েছে কায়িক পরিশ্রম, আর্থিক সঙ্গতি, জীবনের নিরাপত্ত¡া ইত্যাদি। এরপরও আছে প্রকাশযোগ্য ঘটনা, বিষয়, প্রেক্ষাপট, এমনকি শব্দ চয়ন, প্রয়োগ। এতেই শেষনয়, আরো আছে দেশীয়-আন্তর্জাতিক আইন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ বা সম্প্রদায় বা ব্যক্তি বা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা দিক বিচার বিবেচনা, বিশ্লেষণ এবং তীক্ষ বুদ্ধি, প্রত্যুৎপন্নমতির মতো আরো অসংখ্য খুটিনাটির দিক। আর এই কাজগুলো সম্পন্ন করতে অবশ্যই সুশিক্ষিত-বেশি জানাশোনা, নিষ্ঠা-সততা-নীতি-আদর্শের ধারক-বাহকের মানষিকতা সম্পন্ন লোক ছাড়া সম্ভব নয়। ডিজিটাল যুগে হয়ত আগের চেয়ে একটু সহজ মনে হলেও কাজ মূলত: একই। হয়ত কাজের পরিধির কিছুটা এদিক সেদিক করে বাস্তবায়ন করা যায়। বরং আগের তুলনায় বর্তমানে সংবাদপত্রের এক দুঃসময় এবং সাংবাদিকরা চরম নিরাপত্তাসহ দারুণ বিপাকের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে।
পাঠকের উপলব্ধির জন্য যদি আরো বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, আমরা যখন সারাদিন কাজ শেষে রাতে বিশ্রামের ঘুমে যাই। তখনো সংবাদকর্মীরা রাতভর কাজ সম্পাদন করেন। বিকেল থেকেই যতই সময় গড়িয়ে যায় ততই কাজের গতি ও চাপ বাড়তে থাকে। নিউজ বাছাই, কম্পিউটারে কম্পোজ, ট্রেসিং, সেটিং বা পেস্টিং, প্লেট এরপর ছাপার কাজে চলে যায়। পত্রিকাটি ছাপার পরপরই দ্রুত ভাঁজ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য তৎপরতা বাড়ে। ততক্ষণে রাতের শেষভাগ। সংবাদপত্রের গাড়ি, বা ট্রেন, নৌ-আকাশ পথসহ বিভিন্ন উপায়ে সকালেই হকার বা সংবাদপত্রের এজেন্টদের কাছে পত্রিকা পৌঁছানো হয়। হকাররাও সকালেই যার যার পত্রিকার বান্ডিল বুঝিয়ে নিয়ে পাঠকের হাতে পত্রিকা পৌঁছানোর কাজে ছড়িয়ে পড়েন। যত দ্রæত সম্ভব পাঠকের কাছে পত্রিকা তুলে দেয়া সত্যিই এক দূরূহ কাজ।
পাঠকরা সকালেই ৫টাকা বা ১০টাকায় পুরো একটি পত্রিকা হাতে পেয়ে যান। কিন্তু এই ৫টাকা বা ১০টা দামের পত্রিকায় যে পরিমান কাগজ আছে, সেই কাগজের মুল্য যদি দোকানে যাচাই করি তাহলে দেখা যাবে কাগজের মুল্যই বেশি হবে। তাহলে পুরো পত্রিকার ছাপানো খরচসহ কত টাকা হতে পারে! এরমধ্যে যদি কোন লেখার মধ্যে একটা শব্দ হেরফের হয়ে যায়। তাহলে পত্রিকার মালিক পক্ষের কাছে ভুল ধরা পড়ার আগেই হয়ত মিডিয়াটি বন্ধ ঘোষণা হয়ে যাবে। বা এক যুগে কয়েকটি মামলাও হতে পারে। কিংবা বিশৃংখলাও ঘটে যেতে পারে। সাংবাদিক-সম্পাদক গ্রেপ্তার নির্যাতনের বিষয়টাতো আছেই। এভাবে দেখা যায় একটা ঘটনার সূত্র ধরে পুরো দেশের চিত্র মুহুর্তেই পাল্টে গেছে। কাজেই একজন সম্পাদক বা সংবাদকর্মীকেও কত বড় ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়। এটাতো হলো ওভার অল সারাদেশের চিত্র।
যদি মফস্বলের সংবাদপত্রগুলোর দিকে তাকাই তাহলে এর চিত্রটা আরো মর্মস্পর্শী। মফস্বল থেকে পত্রিকা বের হবার বাস্তবতা আরো অবাক করার মতো। মফস্বলের পত্রিকাগুলোর জনবল অত্যন্ত কম। বেশির ভাগ পত্রিকায় সম্পাদক বা তার বিশ^স্ত ২/১জনকে সাথে নিয়ে নিতান্ত অসহায়ের মতো একাই সব কাজ করতে হয়। পত্রিকায় প্রকাশযোগ্য লিখা, বাছাই, টাইপ, ছবি, সেটিং থেকে শুরু করে প্রিন্ট পর্যন্ত সবই একা। একা না করেই বা উপায় কি? কর্মচারি নিয়োগ দিতেও তো ন্যুনতম একটা অংকের মায়না দিতেই হবে। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে ধরে নেয়া যায় প্রকাশিত পত্রিকার কাটতিও কম। মফস্বলের ছোট্র একটা পত্রিকা কিনতে লাগে ৫ টাকা। আবার জাতীয় পত্রিকার মুল্যও ৫টাকা। অর্থাৎ ৫টাকার নিচে কোন পত্রিকার মুল্য নেই। জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। মফস্বলের বেশির ভাগ পত্রিকা বিক্রির টাকা কাগজের দামও ওঠে না। জাতীয় পত্রিকাগুলোর অবস্থাও তাই। তাহলে সংবাদপত্র শিল্প বাঁচবে কিভাবে? এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। সত্যি কথা বলতেই, আঞ্চলিক পত্রিকাগুলো টিকে আছে স্থানীয়ভাবে সংবাদ প্রকাশকে ঘিরেই। জাতীয়ভাবে যেভাবে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন পাবার সুযোগ আছে, স্থানীয়ভাবে সেই সুযোগ নেই। হাতেগোনা কিছু স্থানীয় পত্রিকা টিকে আছে নিতান্তই দুরবস্থা প্রতিকূলতার মধ্যেই।
সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয় লেখক ড. জাফর ইকবালের একটি কলামে তিনি লিখেছেন-বাংলাদেশের মিডিয়া বাড়লেও, আগের মতো সংবাদ নেই। নেই সংবাদের গুরুত্ব। মফস্বলের অনেক বড় বড় ঘটনাই জাতীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় না। হইলেও ভিতরের পৃষ্ঠা বা খুব ছোট করে। একই ধরণের ঘটনা রাজধানী বা শহর কেন্দ্রিক হলে সেটিই ফলাও করে কয়েকদিন ব্যাপী প্রচারিত হয়। এভাবেই প্রতিনিয়তই সংবাদ মিসিং হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে স্থানীয় পত্রিকাগুলো বিশাল ভূমিকা রাখছে। জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ না হলেও, স্থানীয়ভাবে সকল চেনা মুখের উপর কষাঘাত করেও সংবাদ প্রকাশ অত্যান্ত দুরূহ। কোন কোন সংবাদ প্রকাশের পরপরই নেমে আসে নানা খড়ক। এসব কিছুর পরও আঞ্চলিক পত্রিকা টিকে আছে, এটাও এক আজব বিষয়। আজ আর নয়। আরেকদিন অন্য বিষয়।
– লেখক-দৈনিক ইত্তেফাক সংবাদদাতা, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মেলান্দহ প্রেস ক্লাব, জামালপুর।
<!- start disable copy paste –></!->
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.