। মোঃ রাশেদুর রহমান রাসেল ।
সময় চিরদিন শুধুই বয়ে যায়, থেমে সে তো থাকে না। এমনি করে দেখতে দেখতেই ৭ বছর শেষ হলো। আজ ৮ম বর্ষে প্রবেশ করছে দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন করোনাকালকে জয় করতে পেরেছে। ৭ বছরের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এই কঠিনতম সময়েও প্রচার সংখ্যার অবস্থান ধরে রেখেছে সবার শীর্ষে। জামালপুরের স্থানীয় পরিমন্ডলকে অতিক্রম করে আঞ্চলিক পর্যায়ের সংবাদপত্রে তৈরি করেছে এক নতুন ইতিহাস, নতুন অধ্যায়। এ অধ্যায় স্বপ্ন জয় করে সৃষ্টিশীলতার সাফল্যকে এগিয়ে নেওয়ার। আগামী দিনের স্থানীয় মিডিয়াকে পথ দেখানোর। ৮ বছরে পা রাখার এই দিনে সব পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, শুভানুধ্যায়ী, সংবাদকর্মী সবাইকে জানাচ্ছি উষ্ণ অভিবাদন। আপনাদের ভালোবাসায় আমরা সকল প্রতিকুলতার চ্যালেঞ্জ জয় করতে সক্ষম হয়েছি। এগিয়ে চলেছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে সমাজের অগ্রসর ও অনগ্রসর সব শ্রেণির পাঠকের কাছে পত্রিকাটির গ্রহণযোগ্যতা বজায় রেখে। সর্বস্তরের পাঠকই দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিনকে বেছে নিয়েছেন তাদের প্রিয় পত্রিকা হিসেবে। এমনকি করোনাকালেও। শুধু জামালপুরে নয়, অন্য জেলাগুলোতেও তৈরি হয়েছে আলাদা অবস্থান। আজকের এই দিনে সবার কাছে কৃতজ্ঞতা করোনাকালের কঠিন সময়সহ ৭টি বছর পাশে থাকার জন্য।
করোনা সারা দুনিয়াকে বদলে দিয়েছে। বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে শুধু অনলাইনে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ এ চ্যালেঞ্জের বাইরে ছিল না। সেই কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা সহজতর ছিল না। চারদিকে এক উলট-পালট পরিস্থিতি। ভয়, শঙ্কা আর গুজব নিয়েই গেল বছর এই সময়ে করোনাকাল শুরু হয়। পাঠকরা পত্রিকা নিচ্ছিলেন না হাতে, বেসরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যায়। সংবাদকর্মীদের মাঝেও ছিল নানামুখী আশঙ্কা। এক জটিল পরিস্থিতি। করোনা মহামারীর দিন শেষ হয়নি। কিন্তু মানুষের মাঝে বিরাজমান আতঙ্ক কমেছে। মানুষ সচেতন হয়েছে। সংবাদপত্রও আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
প্রিয় পাঠক! বিশ্ববাস্তবতা সবাই জানি। করোনাকালে মানুষের সহনশীলতা আরও কমেছে। বিশ্বের অনেক দেশে আজ গণতন্ত্র, অসা¤প্রদায়িক চেতনা হুমকির মুখে। আর প্রযুক্তির দাপটে প্রিন্টের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দাপট দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে মিডিয়ার জন্য একটা কঠিন পরিস্থিতি। সবকিছু সামাল দিয়েই এগিয়ে চলেছে দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার, সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন গণমানুষের পত্রিকা হিসেবেই থাকবে। সব অন্যায় ও অসংগতির বিরুদ্ধেই থাকবে আমাদের অবস্থান। কথা বলবে সাধারণ মানুষের পক্ষে। অঙ্গীকার অব্যাহত থাকবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি। বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াবে বলিষ্ঠতা নিয়ে। কথা বলবে মানবতার। চেষ্টা থাকবে দায়িত্বশীলতা বজায় রাখার। কারণ দায়িত্বশীল সংবাদপত্র ছাড়া গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। আয়নার মতো সমাজের সব অসংগতি তুলে ধরাই সংবাদপত্রের কাজ। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে মিডিয়ার অবাধ স্বাধীনতা অপরিহার্য। সে স্বাধীনতা ধরে রাখতে মিডিয়া কর্মীদেরও কণ্ঠ থাকতে হবে। ঘরে বসে শুধু আফসোস করলে হয় না। অনেকে এখন সাংবাদিকতা করার চেয়ে দলীয় কর্মী হতে বেশি পছন্দ করেন। সংবাদকর্মী দলীয় কর্মী হলে আর কিছু থাকে না। আবার কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন, নিজের মিডিয়ায় নয়।
প্রিয় পাঠক! নানামুখী জটিলতার এই সময়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে আবারও গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই আমাদের সকল বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রতি।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ লেখা শেষ করছি জেমস অগাস্টাস হিকির উপমা দিয়ে। কলকাতা থেকে বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন হিকি। নাম বেঙ্গল গেজেট হলেও পত্রিকার ভাষা ছিল ইংরেজি। ১৭৮০ সালে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র আমাদের এ অঞ্চলে। ইংরেজ মানুষটি পত্রিকা বের করার পর স্বজনরা খুশি হয়েছিলেন। সবাই আশা করেছিলেন হিকি ইংরেজদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবেন। কিন্তু হিকি তা করেননি। তিনি মানুষের কথা বলেছেন সংবাদপত্রে। ইংরেজদের অপকর্ম তুলে ধরেছেন। প্রশাসনের অনিয়মের খবর ছিল তাঁর পত্রিকায়। ইংরেজদের লুটপাটের কাহিনিও বাদ যায়নি। এমনকি ইংরেজ সেনাদের ব্যর্থতা ও লোভের খবরও প্রকাশিত হতো। ব্যস, আর যায় কোথায়? সবকিছু তুলে ধরার কঠিন খেসারত হিকিকে দিতে হয়েছিল। পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। কারাবরণ করতে হয় তাঁকে। প্রেস জব্দও হয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে আফ্রিকায় দাস পাঠানোর প্রতিবাদ জানিয়েও কলম ধরেছিলেন হিকি। তিনি লিখেছেন, ‘যদি সংবিধান খারিজ হয়, মানুষ দাসত্বে পতিত হয়, একজন সাহসী মানুষ আর একটা স্বাধীন সংবাদপত্র তাদের উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু সংবাদের স্বাধীনতা না থাকলে মস্ত বীরপুরুষও স্বাধিকার, স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে না।’
ভাবতেও পারছি না সে যুগে এভাবে স্পষ্ট করে কথা বলা আর বলতে পারার বীরত্বটা। এ যুগে রবীন্দ্রনাথের একটি কথা মনে পড়ছে। কবিগুরু বলেছেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম।’ কাঠিন্যকে ভালবেসে এ পেশাটাতে থাকতে হয়। একজন পরিপূর্ণ সংবাদকর্মীই পারেন অনেক কিছুর পরিবর্তন আনতে। আর সে কারণে কাউকে কাউকে কঠিন খেসারতও দিতে হয়। জীবনের সব হিসাব-নিকাশ মেলে না এ পেশায়। তবুও মানুষের প্রয়োজনে, মানবতার কল্যাণে আর সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে এ পেশায় যারা নিজেদের সম্পৃক্ত করেন তারা সত্যিই মহত্বের দাবীদার। এ পেশায় অন্যান্য পেশার মতই যথারীতি ভালোর পাশাপাশি মন্দ মানুষের অন্তর্ভূক্তিও কম নয়। আমরা ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে সৎ-সাংবাদিকতার কথা বলছি। তাই প্রকৃত সাংবাদিকগণের উদ্দেশ্যে কবির ভাষায় কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, সকলের তরে সকলে আমরা- প্রত্যেকে মোরা পরের তরে। আসুন পেশাগত মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে নীতিবোধকে প্রাধান্য দিয়ে সৎ-সাংবাদিকতার জয়গান গাই। আমি দ্ব্যর্থহীনকন্ঠে ঘোষণা করতে চাই সৎ-সাংবাদিকদের জন্য দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিনের দরজা সবসময়ের জন্য খোলা আছে এবং থাকবে। আসুন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের বিবেককে জাগ্রত করে গণমানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াই জনস্বার্থের অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় নিজেকে একজন প্রকৃত কলমযোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলি। দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন এর ৮ম বর্ষে পদার্পণ শুভ হোক-সফল হোক। সকলকে আবারও ধন্যবাদ!
লেখকঃ সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন।