স.স.প্রতিদিন ডেস্ক ।।
সোশাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন আসছে। এই আইনে বড় ধরনের শাস্তির বিধান রেখে খসড়া তৈরির জন্য কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব শাখার বিষয়ে একটি আধুনিক ও কার্যকর আইনের খসড়া তৈরি হলে, ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে। আইন তৈরির কাজ চলছে। আশা করা যাচ্ছে নতুন বছরের শুরুতেই আইনের খসড়া তৈরি হয়ে যাবে। পরে আইনটি সংসদে তোলা হবে। এ তথ্য জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
মন্ত্রী বলেন, ফেসবুক, ইমু, ভাইভার ও ইউটিউব সমাজে যে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তা টাকার অঙ্ক দিয়ে বিচার করা যাচ্ছে না। এই ক্ষতির কোন সীমা নেই। আমরা হেফাজতকে মোকাবেলা করতে পেরেছি। কিন্তু ফেসবুককে মোকাবেলা করতে পারছি না। প্রতিদিন হাজার হাজার কনটেন্ট ফেলে দেয়া হচ্ছে। আবার প্রতিদিন হাজার হাজার যোগ হচ্ছে। এই মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এটা এত শক্তিশালী হয়ে উঠবে তা ভাবনায় ছিল না। এখন এটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। অপপ্রচারের বড় মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে। অপপ্রচার ও জঙ্গীবাদ উস্কে দেয়ার বড় হাতিয়ারের নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই হাতিয়ারকে ব্যবহার করে সমাজে বহু অঘটন ঘটেছে। চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে, নাসিরনগরে তাণ্ডব চালানো হয়েছে। যার খেসারত দিতে হয়েছে এদেশের মানুষকে। ফেসবুক এখন অপ-মাধ্যম হিসাবে চলছে। তাদের অফিস খোলার জন্য বহুবার অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা সে কাজটি করেনি। এখন আমাদের বাধ্য হয়েই হার্ড লাইনে যেতে হচ্ছে। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তান পর্যন্ত আইন করে ফেসবুক নিয়ন্ত্রণ করছে। যুক্তরাজ্যে ফেসবুকের ওপর কঠিন কাড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে ফেসবুকের সঙ্গে বৈঠক করা হচ্ছে, তারা আমাদের কথা মানছে না। তারা তখন যে কথা দিয়েছিল-তার কোনটাই বাস্তবায়ন করেনি। বৈঠকে সিদ্ধান্ত ছিল ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের আইনী কাঠামো ও সংস্কৃতি মেনে চলবে।
কিন্তু তারা সে কথা রাখেনি। বলেছিল বাংলা ভাষার সঠিক অনুবাদ ও প্রয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব দেবে ফেসবুক। এর ফলে ‘বাজে কনটেন্ট’ প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অপপ্রচার সহজেই বন্ধ হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কাজ হবে যদি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে অফিস খোলে। অফিস খোলার বিষয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়ে আবার তারা এ জায়গা থেকে সরে গেছে। ফেসবুকের আধিপত্য কমাতে যুক্তরাজ্যে নতুন আইন জারি হচ্ছে। সামনের বছর থেকেই এই আইন কার্যকর হবে। অনলাইন দুনিয়ায় একতরফা আধিপত্য চালিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে বলে ফেসবুকের বিরুদ্ধে তারা এ ব্যবস্থা নিচ্ছে। নতুন আইনের আওতায় গ্রাহকদের নিজেদের তথ্যের ওপর তাদের আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রদানের চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশ ফেসবুক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কঠোর আইন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এতদিন আইনের বিষয়টি নিয়ে ভাবা হয়নি। দিন যত যাচ্ছে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ততই বাড়ছে। বর্তমানে সাড়ে তিন কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছেন। আর এখান থেকে প্রতিবছর সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন নিয়ে চলে যাচ্ছে। দেশের সংবাদ মাধ্যম এতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে বিজ্ঞাপনের বাজার ফেসবুকের কারণে ছোট হয়ে যাচ্ছে। এই জায়াগা থেকে আমাদের বের হতে হবে। তার জন্য ইতোমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। ফেসবুকের ধারণার চেয়ে দেশে ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে। এখন তাদের আমাদের হিসাবের মধ্যে নিতে হবে। আমরা ফেসবুককে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসব। তাদের একক আধিপত্য বিস্তারে লাগাম টেনে দেয়া হবে। ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের জন্য যেসব ক্ষেত্রে অর্থায়ন করা হয় সেগুলো কিভাবে সেবা দিচ্ছে এবং গ্রাহকদের তথ্য তারা কিভাবে ব্যবহার করছে সে বিষয়টি স্বচ্ছ হতে হবে। গ্রাহক কোন ধরনের বিজ্ঞাপন গ্রহণ করবেন সে বিষয়ে তাদের বিভিন্ন বিকল্প উপস্থাপন করবে প্রতিষ্ঠানগুলো এবং তাদের গ্রাহকদের ওপর কোন ধরনের সীমাবদ্ধতা আরোপ থেকে দূরে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে গ্রাহকদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা সহজ হবে। প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত স্থগিত, অবরোধ এবং পাল্টে দেয়া ও অমান্য করার জন্য আর্থিক জরিমানা আরোপ করা হতে পারে।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বছরের নবেম্বরে ডাক ও টেলিযোগ মন্ত্রী ফেসবুক প্রতিনিধিদলের কাছে প্রথমেই অনুরোধ করেন বাংলাদেশে তাদের একটি অফিস খোলার জন্য। এ সময় ফেসবুক প্রতিনিধিদল মন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন তাদের চিন্তা রয়েছে বাংলাদেশে অফিস খোলার। মন্ত্রী তখন তাদের বক্তব্যে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ফেসবুক বাংলাদেশে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, পর্নোগ্রাফি, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, অপপ্রচার জঙ্গীবাদের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ফেসবুক ব্যবহার হচ্ছে। এগুলো বন্ধ না হলে সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাছাড়া বাংলা ভাষার সঠিক অনুবাদ না হওয়ায় আরও জটিলতা তৈরি হচ্ছে। নিজস্ব সংস্কৃতি কনটেন্ট প্রকাশ না হলে সমাজে এর প্রভাব ব্যাপক হারে পড়ছে। এসব কথা শোনার পর ফেসবুক প্রতিনিধিদল বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু গত এক বছরেও তারা বাংলাদেশের বিষয়ে কোন কিছু করেনি। নিরাপত্তা বিষয়ে বাংলাদেশের রেগুলেশন মেনে নিরাপদ ফেসবুক ব্যবহারের ব্যবস্থা করার জন্য ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছিল। তখন বাংলাদেশে ফেসবুক পার্টনারও উপস্থিত ছিলেন। এখন তিনি দেশের বাইরে থাকেন। তাকেও ধরা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের সমাজ, নাগরিকদের ফেসবুকের নিরাপদ ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের আইন, আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং নিয়মনীতি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, বাংলাদেশে আইন আছে, সেই আইন মোতাবেক ফেসবুককে কনটেন্ট এবং অন্যান্য বিষয় বাস্তবায়ন করতে হবে। কন্টেন্ট ফিল্টারিং অথবা যে ধরনের বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করা দরকার সেগুলো করার কথা। রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছিল। ফেসবুক ওই বৈঠকে কন্টেন্ট প্রকাশে তাদের গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডের বিষয়টি তুলে ধরেছিল। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের আইনী কাঠামো ও সংস্কৃতি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়। ফেসবুক তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। অফিসও খোলেনি। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করে তাদের সিস্টেম থেকে পর্নোগ্রাফি সরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম চলছে। ফেসবুক কন্টেন্ট বিষয়ে বিদ্যমান যেকোন সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য বাংলাদেশে অফিস খোলার বিষয়ে মন্ত্রী গুরুত্বারোপ করে বলেন, রেসপন্স টাইমের বিষয়ে ফেসবুক যে দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নেয় সেটিকে ইমিডিয়েট রেসপন্স টাইমে আনতে হবে।
সরকার কখনও চায় না ফেসবুক বন্ধ করতে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৯৫ ভাগ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মোবাইলে। বাংলা ভাষার সঠিক অনুবাদ করার জন্য ফেসবুক যদি কোন সহযোগিতা চায়, সে লক্ষ্যে শেখ হাসিনার সরকার সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা করবে। ফেসবুকে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কিছু সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা দূর করতে হবে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ যেন ফেসবুকে বাংলা পড়তে কোন অসুবিধার মধ্যে না পড়েন। বাংলার ভাষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে বলে জানান ফেসবুকের গ্লোবাল পলিসি সলিউশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্জ এ্যালান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি তারা রাখেননি। এখন নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই তৈরি করা হবে।
